সংবাদচর্চা রিপোর্ট
নারায়ণগঞ্জ জেলায় এসে একটি রুট ম্যাপ তৈরী করেন পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদ। শহর হকারমুক্ত, মাদক বিক্রেতা, চাঁদাবাজ, জুয়াড়িদের ধরতে তিনি সাঁড়াশি অভিযান চালান। এতদিন যারা ক্ষমতার প্রভাবে নিজেদের আলাদা জাত ভাবতেন, তাদের ঢেরায়ও হানা দিতে কুন্ঠাবোধ করেননি তিনি। তার হঠাৎ বদলীর ঘটনায় প্রভাবশালী মহল বিশেষ করে শামীম ওসমান অনুগতরা যারপরনাই খুশী হয়েছে। তাদের মধ্যে কতিপয় নেতাকর্মীর কয়েকদিনের কর্মকান্ড দেখে দলের ভেতরই একটি অংশ সমালোচনা করেছেন। তারা বলছেন, রোববারের পর থেকে ওই নেতাদের পুরনো মুখোশ ফের খসে পড়েছে। এদিকে পুলিশের সূত্র বলছে, উপর থেকে যে গাইড লাইন দেয়া হয়েছিলো এসপি হারুন সেভাবেই চলেছেন। তবে তার ব্যক্তিগত কোন মন্দ কাজের দায় শুধু তিনিই বহন করবেন। আর নতুন যে এসপি যোগ দিবেন, তিনিও আগের লাইনেই চলবেন।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে শামীম ওসমানের প্রভাব অনেক আগে থেকেই। ছাত্র জীবন থেকেই তিনি শক্তির রাজনীতিতে সিদ্ধহস্ত হন। তোলারাম কলেজ ছাত্র ছাত্রী সংসদের ভিপি হওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া তার রাজনীতি ঘিরে রয়েছে একটা বিশাল ফ্রেন্ড সার্কেল। বন্ধু, বন্ধুর বন্ধু, পরিচিতজন ও কর্মী মিলে তার অনুগতের সংখ্যা অনেক, যা স্বীকার করেন তার বিপক্ষের লোকেরা। এ অগণিত অনুগতদের ঝানু রাজনীতিক শামীম ওসমান তার যাদুময়ী বক্তৃতা ও ভিন্ন রকম কৌশল দিয়ে যুগের পর যুগ আটকে রেখেছেন বলে মনে করে রাজনীতি বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, কেউ সুবিধা পেয়ে, কেউ বক্তৃতা শুনে কেউ আবার স্বজন কিংবা কাছের মানুষ হওয়ার সুবাদে এ বলয়ে আজীবন আটকে গেছেন। এরমধ্যে কয়েকজন এদিক-সেদিক করে ফেরত আসেন আবার কেউ কেউ অন্য বলয়ে চলে গেছেন। তবে সব মিলিয়ে এখনও শামীম ওসমানের অনুগত সংখ্যা কম নয়। যদিও অনেকে মনে করেন, আগের মতো নেই। তবে অনুগতদের এ মিছিল তাকে অনেকের কাছে একেক রকম গ্রহনযোগ্যতা এনে দিয়েছে। কেউ কেউ তার বলয়কে রাজনৈতিক কর্মকান্ডে ব্যবহার করতে বাহ্বা বাহ্বা দিয়েছেন কেউ আবার মুখ ঘুরিয়ে বলেছেন, এটা পেশী শক্তির রাজনীতি। একপক্ষ বলেন, শামীম ওসমান একজন দক্ষ সংগঠক আরেক পক্ষের মতে, তিনি মন্দ রাজনীতির পথিক। পক্ষে বিপক্ষের এসব কথা ছাপিয়ে শামীম ওসমানের প্রভাবের কথা কেউ অস্বীকার করেননা। দাপুটে ও ক্ষমতাবান এ রাজনীতিক এতকাল প্রভাব দেখাতে পারলেও গত কয়েক মাস কোনঠাসা অবস্থায় পড়েছিলেন।
শহরের সচেতন মহলের মতে, প্রভাবশালী রাজনীতিক হলেও শামীম ওসমান কে কোনরকম পাত্তা দেননি এসপি হারুন। বরং তিনি সব সময়ে এ রাজনীতিক ও তার অনুগতদের একটা ভীতিকর অবস্থায় রেখেছেন। টেনু গাজী-মীর থেকে শুরু করে কাউন্সিলর বাবু, কাউন্সলির দুলাল প্রধান, কাউন্সিলর কবির হোসাইন, সাবেক কাউন্সিলর মুন্না অতীতে স্বপ্নেও গ্রেপ্তার হওয়ার কথা ভাবেননি। তেমনি সচেতন মহল চিন্তাই করেনি, যে শাহ নিজামের বিরুদ্ধে জিডি হবে, অয়ন ওসমানের সমন্ধি ভিকি গ্রেপ্তার হবে। সচেতন মহলের মতে, তারা সবাই শামীম ওসমানের অনুগত আর তাদের বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস এ যাবতকাল কেউ দেখাননি। এসপি হারুনের আমলে সে সাহস দেখাতে পেরেছে মানুষ। তিনি কোন প্রভাবশালীর তদবির কানে তুলেননি। অনেকের মতে, দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক জীবনে এ প্রথম বড় ধাক্কা খেয়েছেন শামীম ওসমান। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাকালে প্রশাসন থেকে তার কিংবা তার বলয়ের উপর এমন খড়গ আসবে তা তিনি নিজেও কল্পনা করেননি। পুলিশের সূত্র জানিয়েছে, বিষয়টি এসপি হারুনের ব্যক্তিগত নয়। তিনি উপর মহল থেকে যেভাবে নির্দেশনা পেয়েছেন সেভাবেই কাজ করেছেন। অর্থাৎ আইনশৃঙ্খলা ঠিক রাখতে কাউকে ছাড় না দেয়ার একটা কড়া নির্দেশনা ছিলো তার উপর। দলীয় সূত্র জানায়, শামীম ওসামনের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ থাকায় শীর্ষ পর্যায়ে তার অবস্থান নড়বড়ে হয়ে পড়ে। জেলার আওয়ামী লীগ নেতার বেশীরভাগ তার বিরুদ্ধে থাকায় শীর্ষ পর্যায়েও পরিবর্তন আসে। আর এ কারনেই এসপি হারুনের মতো পুলিশ অফিসার দিয়ে শায়েস্তা করার কৌশল এঁটেছে দল।
এদিকে রোববার স্বরাস্ত্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে এসপি হারুনের বদলীর খবর শুনে উল্লাসিত হয়েছে শামীম ওসমান অনুগতরা। তাদের নিয়ে সোমবার চাষাঢ়া রাইফেল ক্লাবে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছে শামীম ওসমান। ওইদিন ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন অংগ সংগঠনের শীর্ষ নেতারা দল বেধে ফতুল্লা মডেল থানায় যান। অনেক দিন পর তাদের এ থানায় যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিলো পুরনো মামলার বিষয়ে ফাইনাল চার্জশিট দিতে পুলিশকে বলা। সূত্র মতে, এসপি হারুন আসার পর অনেকেই থানায় যাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। কেউ গেলেও চুপিচাপি যেতেন। শুদ্ধি অভিযানের পর রাইফেল ক্লাবে আসাও ভুলে গিয়েছিলেন অনেকে। বেশ কিছু দিন ধরে রাইফেল ক্লাবে লোকজনের আনাগোন ছিলো কম। তবে এসপির বদলী হওয়ার পরের দিন সোমবার থেকে রাইফেল ক্লাব ফের জমজমাট হয়ে উঠে বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা।
আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্ববান নেতা জানান, এসপি হারুনের নিয়োগ ও বদলী দু’টোই মন্ত্রণালয় করেছে। এখানে সরকারের মত ছিলো। তিনি ভালো করতে পারবেন এমন ভেবেই নারায়ণগঞ্জের দায়িত্ব দেয়া হয়। অনেক ভালো কাজ করে তিনি তার নিজের ভাবমুর্তি তুলে ধরেছেন। আবার পারটেক্স গ্রুপের মতো সনামধন্য শিল্পপতি পরিবারের সাথে যা হয়েছে তা এসপি হারুনের ভাবমুর্তি নষ্ট করেছে।
এদিকে পুলিশের সূত্র জানিয়েছে, নারায়ণগঞ্জের বিষয়টি সরকার ও স্বরাস্ত্র মন্ত্রনালয় আলাদা ভাবে চিন্তা করেন। যে কারনে এখানে এসপি হারুনকে দেয়া হয়েছিলো ঠিক সে কারনেই এখানে নিষ্ঠাবান ও চৌকষ পুলিশ সুপার দেয়া হবে। যিনি কারও চোখ রাঙানিতে থমকে যাবেন না এমন সাহসী পুলিশ কর্মকর্তা আসবেন এ জেলায়। সূত্র আরও জানায়, কয়েকজনের একটা তালিকা করে তাদের প্রোফাইল দেখা হচ্ছে। যারা ইতিমধ্যে বিভিন্ন জেলায় দায়িত্বে রয়েছেন তাদের কয়েকজন এ তালিকায় আছেন তেমনি নুতন মুখও আছেন। তাই কে আসছেন, তা এখনি বলা যাচ্ছে না। তবে একজন নারী এসপির বিষয়ে জোর গুঞ্জন রয়েছে। তবে যেই আসুক উর্ধ্বতনদের নির্দেশে যে রুট ম্যাপ এসপি হারুন তৈরী করেছেন তাই আগামীতে চলবে বলে জানায় পুলিশের এ সূত্র।